IOI ২০১৪ - তাইপেই তে প্রথম দিন

হাসনাইন হেইকেল জামি | জুলাই ১৩, ২০১৪
আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড ২০১৪ তে বাংলাদেশ দলের সাথে তাইওয়ান গেছেন দলনেতা হাসনাইন হেইকেল জামি। তার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিদিন Progক্রিয়া তে লিখবেন তিনি।

IOI 2014

IOI 2014 এর অফিসিয়াল লোগো, তাইপেই, তাইওয়ান। ফটো কার্টেসি - IOI 2014 ফেসবুক পেইজ।



গতকাল (১২ জুলাই) রাতে এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের নিতে আসতে আসতে আসলে ১৩ জুলাই শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে লোক শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে নিতে এসেছিল, তাকে আমরা আসলে প্রায় তিন ঘন্টা ধরেই আজারবাইজান লেখা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ঘুরতে দেখেছিলাম। একবার মনে হয়েছিল হয়ত আই ও আই এর জন্যই সে এসেছে। কিন্তু পরে কি কারণে আমরা আর গিয়ে আর কথা বলি নাই। হয়ত বললে অনেক আগেই আমরা এয়ারপোর্টে বসে থাকার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম। ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আর কি!

তাইপেই এয়ারপোর্টে এসে আমরা পৌছেছিলাম স্থানীয় সময় সকাল ১১টায়। ভিসা আর ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে করতে বেজে গিয়েছিল প্রায় ১ টা। এর পর বের হয়ে এরাইভাল লবিতে বসে শুরু হয় আমাদের অপেক্ষা। যে অপেক্ষার অবসান ঘটে রাত প্রায় ১২টায়। পাঠক যদি মনে করে থাকেন যে এটা আয়োজকদের চরম অব্যবস্থাপনা, তাহলে ভুল ভাবছেন। আসলে আমরা নিজেরাই অনেক তাড়াহুড়ার মধ্যে আসায় আমাদের যাত্রা নিশ্চিত করতে পারি নাই। ১২ তারিখ কোন টিমেরই আসার কথা ছিল না। আর কুনমিং এ বসে আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করলেও গুগোল ব্লকড থাকার কারণে আমরা তাও পারি নাই।

তাইপেই এয়ারপোর্টের নাম হল তাওইউয়ান এয়ারপোর্ট। শহরের থেকে পঞ্চাশ কিলো মিটার দূরে অবস্থিত এই এয়ারপোর্ট। হোটেলে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে উঠিয়ে দেওয়া হল লাল রঙের টুরিস্ট বাসে। সেই বাসে আমরা ছিলাম শুধু সাতজন। বাংলাদেশের ছয়জনের সাথে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা আই ও আই সায়েন্টিফিক কমিটির মেম্বার বেন বার্টন ছিল আমাদের সাথে। দেখা গেল যথারীতি তার সাথে কায়কোবাদ স্যারের পুরনো পরিচয়। বাসে উঠেই স্যার গল্প জুড়ে দিলেন তার সাথে।

আমাদেরকে নিয়ে আসা হল কন্টেস্ট্যান্টদের জন্য নির্দিষ্ট ফুলন হোটেলে। এই হোটেলটি একটু শহরের বাইরে। আশেপাশের এরিয়া হয়ত একটু নোংরা। চাইনিজ ভাষায় লেখা দোকানের সাইন বোর্ড গুলো না থাকলে ভুল করে মনে হতেই পারে যে আমরা ঢাকাতেই আছি। ভিতরে ঢুকে অবশ্য কোন ভাল সংবাদ পাওয়া গেল না। যেহেতু আমরা প্রায় একদিন আগে চলে এসেছি, তাই হোটেলে আমাদের জন্য রুম খালি পাওয়া গেল না। আমরা ছাড়াও বেশ কিছু টিম ততক্ষনে চলে এসেছে। মধ্যরাতে ছুটোছুটি করে আমাদের জন্য হোটলের নিচে লাউঞ্জেই সোফায় শুয়ে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিল এখানকার ভলান্টিয়ার জেকিল। এই অসুবিধার জন্য অনেকবারই সরি বলেছে সে। অবশ্য আমরা এয়ারপোর্ট থেকে আসতে পেরেই খুশি ছিলাম।

রাতের বেলা সোফায় শোয়া সেই ঘুম ভাঙ্গল সকাল বেলা ভলান্টিয়ারদের চাইনিজ কিচিরমিচিরে। প্রায় একশটি দেশের টিম গাইড এবং আরো ভলান্টিয়ার মিলে পুরো লাউঞ্জ সরগরম করে তুলল। কথা বলে জানা গেল, ঐ লাউঞ্জটাই নাকি ভলান্টিয়ার স্টেশন। একটু পরেই আমাদের টিম গাইড ভিভিয়ান এসে আমাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিল। হাইস্কুল পড়ুয়া মেয়ে। দুপুরে খেতে বসে আমরা তার কাছে কিছু চাইনিজ তালিমও নিয়ে ফেললাম। সেও আমাদের কাছ থেকে কিছু বাংলা শিখে নিল।

প্লেনের খাবার আমাদের খুব অদ্ভুত লাগলেও এইখানের খাবার বেশ ভাল ছিল। যদিও আমরা শুধু ফ্রাইড রাইস আর নুডুলস দিয়ে খেলাম, কিন্তু অন্য খাবার গুলো চেখে দেখেও খারাপ লাগেনি। সবচেয়ে ভাল ছিল, খাওয়ার পর ডেজার্ট আইটেম গুলো। সাথে কোকাকোলা, স্প্রাইট, ফান্টা বা অরেঞ্জ জুস। যার যেটা খুশি।

খাওয়ার পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল তাইপেই জুতে। চিড়িয়াখানাটা বেশ বড়। কারণ, এর ভিতরে শাটল ট্রেন সার্ভিস আছে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যাওয়ার জন্য। মজার ব্যাপার ছিল, গরম কে সহনীয় পর্যায়ে নিতে পুরো চিড়িয়াখানা জুড়েই কিছু ধাতব পাইপের মাধ্যমে একটু পর পর পানি ছিটানো হয়। আমাদের কাছে অবশ্য তাতে গরমের খুব একটা হেরফের হয়নি। গরমে কাবু হয়ে আমরা শুধু পান্ডা আর পেঙ্গুইন দেখেই আমাদের চিড়িয়াখানা ট্যুর শেষ করি। এই দুইটার ঘর দুইটাই ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এইজন্য আমরা পেঙ্গুইনের ঘরে অনেকক্ষন বসে ছিলাম। তন্ময় সেখানের মেঝেতে শুয়ে ছোট্ট একটা বিশ মিনিটের ঘুমও দেয়!

আজকের কর্মসূচীতে কন্টেস্ট্যান্টদের জন্য “ট্যালেন্ট শো” এর ব্যবস্থা থাকলেও লিডারদের জন্য আর কিছু ছিল না। তাই আমরা এসে আমাদের হোটেল “হোটেল গ্রান্ড হায়াত” এর রুমে এসে উঠি। পাঁচ তারকা হোটেলটি বিশাল বড় আর সুন্দর। তবে আমরা বেশি খুশী ছিলাম রুমের টিভিতে ইংরেজী চ্যানেল খুজে পেয়ে। হোটেলের নিচ তলায় বড় পর্দায় আজকের রাতের আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল দেখার প্রস্তুতি দেখেও বেশ মজা লেগেছে।

রাতের ডিনার করতে গিয়ে আমাদের প্রোগ্রমিং জগতের দুইজন বেশ বড় বড় নামের সাথে দেখা হয়ে গেল। এদের একজন হচ্ছেন বর্তমানে ইউসাকোর (USACO) এর আয়োজক ও যুক্তরাষ্ট্র দলের দলনেতা ব্রায়ান ডিন। আমাদের পাশের টেবিলে বসেই ডিনার করছিলেন Michal Forišek যিনি misof নামেই অধিক পরিচিত। হায়াত হোটেলের ডিনারটি এক কথায় ছিল অসাধারণ। তার সাথে আমাদের জগতের সেলিব্রিটিদের দেখতে পেরে আরো ভাল লাগছিল। সারাদিন ভাল কাটলেও রাতে ঘুমাতে এসে দেখা দিল বিপত্তি। কুনমিং এও ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলাম, কায়কোবাদ স্যার নিজেও বলেছিলেন যে তার ঘুমের সময় শ্বাস আটকে আসে মাঝে মাঝে, কিন্তু তাইপেইতে আজকে রাতে স্যারের নাক ডাকানো অন্য পর্যায়ে চলে গেল। কিছুক্ষন ঘুমানোর চেষ্টা করে বরং এই লেখা লেখাই শ্রেয় মনে হল আমার কাছে। লিখতে লিখতে রাতের খেলা দেখার সময়ও প্রায় হয়ে এলো। এখন তাই এখানেই শেষ।


হাসনাইন হেইকেল জামি

হাসনাইন হেইকেল জামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং একাধিক ন্যাশনাল প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং টিমের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।