ACM ICPC ওয়ার্ল্ড ফাইনালস প্রোগ্রামারদের জন্য অনেকটা স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার। গতবছর পুরো পৃথিবীর ৯১টা দেশের ২,৩২২ টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৯,৪৭৯ জন প্রোগ্রামার এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং তাদের মধ্যে সেরা ১২০ টি দল আমন্ত্রণ পায় সেইন্ট পিটার্সবার্গে আয়োজিত চূড়ান্ত প্রতিযোগীতায়। ঢাকা রিজিওনাল থেকে ২০১৩ ওয়ার্ল্ড ফাইনালের জন্য কোয়ালিফাই করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম চোকার এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম প্যালিনড্রম। ১৯৭৭ সাল থেকে আয়োজিত ACM ICPC কে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৃথিবীর সব থেকে সম্মানজনক এবং ঐতিহ্যবাহী প্রোগ্রামিং প্রতিযোগীতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্যালিন্ড্রমের জন্য এটা ছিল দ্বিতীয় ওয়ার্ল্ড ফাইনালস। প্যালিন্ড্রমের টিম মেম্বাররা ছিলেন মো: মাকসুদ হোসেন শিবলী, ফরহাদ আহমেদ এবং বাকের মোহাম্মদ আনাস। আর চোকারের টিম মেম্বাররা হলেন নাজমুল হাসান রিয়াদ, প্রসেনজিৎ বড়ুয়া লিংকিন এবং মোঃ হাফিজ উদ্দিন। রিয়াদদের জন্য এটা প্রথম ওয়ার্ল্ড ফাইনালস হলেও জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় শেষ কিছু বছরে তাদের পারফরমেন্স ছিলো দূর্দান্ত। চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন একাধিক ন্যাশনাল কন্টেস্টে। Progক্রিয়ার সাথে ওয়ার্ল্ড ফাইনালস নিয়ে আমাদের বিস্তারিত কথা হয় রিয়াদ, লিংকিন এবং হাফিজের সাথে।
ঢাকা রিজিওনাল থেকে কোয়ালিফাই করার পর চোকার চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত সার্ক প্রোগ্রামিং কনটেস্টে। তারপর জানুয়ারীতে হাফিজ কুরুক্ষেত্র অনলাইন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে চ্যাম্পিয়ন হয় পুরো দক্ষীণ এশিয়ার সব প্রোগ্রামারদের হারিয়ে।
জুলাই এর শুরুতে তারা যাত্রা করে রাশিয়ার উদ্দেশে। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়াতে সরাসরি প্লেন যায় না। প্রায় ১০ ঘন্টা যাত্রার পর ট্রানজিট দুবাইতে। সেখান থেকে আবার যাত্রা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে। আরো দীর্ঘ কিছু সময় পর প্লেন গিয়ে নামে মস্কোতে। রাশিয়ায় যাবার পর মজার কিছু কান্ড ঘটে। সেখানে নাকি সবাই সোডা ওয়াটার খেতে অভ্যস্ত, না বুঝে এক ঢোক পানি গলায় ঢেলে বিষম খেতে হয় লিংকিনকে! সব থেকে সমস্যার ব্যাপার হলো রাশিয়ার মানুষজন ইংরেজীতে কথা বলে অভ্যস্ত না। অনেকবার বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে “ফ্রেশ ওয়াটার প্লিজ” বলে পানি আনার পর দেখা গেলো সোডার থেকে সাধারণ পানির দাম বেশী!
রাশিয়াতে খাবার নিয়েও বিপদে পড়তে হয়েছে। অনেক বুদ্ধিমানের মতো রান্না করা স্যামন মাছ কিনে দেখা গেলো সেটা আধা-কাঁচা। মুরগী ছাড়া প্রায় কিছুই নাকি খাওয়ার যোগ্য ছিলো না। আরেকটা সমস্যা হলো রাশিয়ানরা সব খাবার গ্রাম হিসাবে বিক্রী করে। গ্রাম হিসেবে সাসলিক কিনতে গিয়ে বহু হিসেব নিকেশ করে পর দেখা গেল পরিমাণে অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে।
মস্কো থেকে তারপরের গন্তব্য ছিল সেইন্ট পিটার্সবার্গ। প্রতি বছরই কনটেস্ট শুরুর আগে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় কারা জিতবে সেটা নিয়ে। এবার ফেভারিটের তালিকায় শুরুতেই রাখা হচ্ছিলো সেইন্ট পিটার্সবার্গ ন্যাশনাল রিসার্চ ইউনিভার্সিটিকে। কারণ তাদের দলে ছিলো বেলারুশের গেন্নাদি করতকেভিচ। একাধিকবার আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের চ্যাম্পিয়ন এবং টপকোডারের সবচে’ কম বয়সী টারগেট গেন্নাদিকে সবাই চেনে তার টপকোডারের হ্যান্ডেল দিয়ে - টুরিস্ট হিসেবে। টোকিও ইউনিভার্সিটিতেও ছিলো কিছু সুপারস্টার কোডার। তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের দলগুলোও পিছিয়ে ছিলো না মোটেও।
ওয়ার্ল্ড ফাইনালস লাইভ ব্রডকাস্ট করা হচ্ছিলো অনলাইনে। আর সাথে অনলাইন র্যাংকলিস্ট তো ছিলোই। ১৭ মিনিটের মাথায় প্রথম প্রবলেম সলভ করে টুরিস্টের দল। প্রতিটি প্রবলেম সলভ করার সাথে সেই টিমকে একটা বেলুন দেয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেলুনে বেলুনে ভরে যেতে থাকে পুরো হলঘর। ৩২ মিনিটের মাথায় প্রথম প্রবলেমটা সলভ করে চোকার। সেটা ছিলো বাইনারি সার্চ সম্পর্কিত একটা প্রবলেম। ৮৪ মিনিটে প্যালিনড্রম তাদের প্রথম প্রবলেম সলভ করে।
এরই মধ্যে প্রথম দিকের দলগুলোর রীতিমতো মারামারি চলছে। কখনো তাইওয়ান, কখনো সেইন্ট পিটার্সবার্গ, কখনো শাংহাই সবার উপরে। কিন্তু তিন ঘন্টা পার হতে না হতেই ফেভারিট দল সেইন্ট পিটার্সবার্গ ন্যাশনাল রিসার্চ ইউনিভার্সিটি সবার উপরে উঠে যায়। বাকি সবার সাথে তাদের দুই প্রবলেমের বিশাল ব্যাবধান। এর পরে তাদেরকে আর কেও ধরতে পারেনি। ১৯৮ মিনিটের সময় চোকার তাদের ২য় প্রবলেমটা সলভ করে এবং ২৪৩ মিনিটের সময় ৩য় প্রবলেম সলভ করে। কনটেস্ট শেষ হবার ২৩ মিনিট আগে প্যালিনড্রম সলভ করে আরেকটি প্রবলেম।
প্রোগ্রামিং কনটেস্টের একটা নিয়ম হলো ৪ ঘন্টা হবার পর র্যাংকলিস্ট ফ্রোজেন করে দেয়া হয়। তখন যে যাই সলভ করুক অন্য কোন টিম বা অনলাইনে বসে থাকা দর্শক সেটা দেখতে পায়না। কনটেস্ট শেষ হবার পর পুরষ্কার বিতরণীতে ফাইনাল রেজাল্ট জানানো হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে সলভ করার পর কনটেস্টেন্টদের লাফালাফি এবং “ইয়েস” বলে চিৎকারেই আশেপাশের দলগুলো যা বোঝার বুঝে যায় এবং পুরষ্কার বিতরণীর আগেই সবাই বুঝে যায় তাদের পজিশন কত। ২৮৫ তম মিনিটে টুরিস্টের অস্থির হয়ে হাঁটাহাঁটি এবং আকষ্মিক উল্লাস দেখেই সবাই বুঝতে পারলো তারা ১০টা প্রবলেম সলভ করে ফেলেছে! ACM ICPC ওয়ার্ল্ড ফাইনালসের ৩৭ বছরের ইতিহাসে এর আগে কখনো কেউ ১০টি প্রবলেম সলভ করতে পারেনি।
শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় সেইন্ট পিটার্সবার্গ ন্যাশনাল রিসার্চ ইউনিভার্সিটি। ২য় এবং ৩য় যথাক্রমে চীনের শাংহাই জিয়াতং এবং ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি। আমাদের দুটো দল বুয়েট ৬৬ তম আর শাহজালাল ৯২তম অবস্থানে।
সাধারণত যারা অন্যান্য দেশ থেকে ওয়ার্ল্ড ফাইনালসে অংশ নেয় তারা ছোটবেলা থেকে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগীতা করে আসছে। যেমন টুরিস্টের প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতা ছিলো ২০০৬ এর আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড। সেটার প্রায় সাত বছর নিয়মিত অনুশীলনের পর সে অংশ নেয় তার প্রথম ACM ICPCতে। সেই তুলনায় আমাদের বেশিরভাগ ওয়ার্ল্ড ফাইনালিস্ট প্রোগ্রামিং এর সাথে পরিচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর।
ওয়ার্ল্ড ফাইনালস থেকে ফিরে আসার পর শিবলী, ফরহাদ এবং বাকের ব্যস্ত ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা বানানোর জন্য। রিয়াদ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করেন গুগলের হেড কোয়ার্টারসে।
লিংকিন এবং হাফিজের প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট ক্যারিয়ার এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তারা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন নভেম্বরের শেষে ঢাকা রিজিওনালের জন্য এবং আরেকবার ওয়ার্ল্ড ফাইনালসে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যাবার জন্য।
লিংকিন, হাফিজ এবং ঢাকা রিজিওনালের সব কন্টেস্ট্যান্টদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে শুভ কামনা। Good luck and have fun!