যদিও ফলাফলের বিষয়টা সবাই আগে থেকে আঁচ করতে পারছিল, এরপরেও যখন রানার-আপ দলটির নাম ঘোষিত হল, ঠিক যে মুহূর্তে সন্দেহের আর কোন অবকাশই রইলো না, সেই মুহূর্তে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাজা গর্জে উঠলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙ্গা জয়োল্লাসে। আর সেটি শত সহস্রগুণে বেড়ে গিয়ে উৎসবে পরিণত হল চূড়ান্ত ঘোষণার পর। এই প্রথমবারের মতো ঢাকা রিজিওনালের শিরোপা ঢাকার বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয় জিতেছে এবং সেই সাথে সেটা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং ফেভারিট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে হারিয়ে - উল্লাস কেনই বা কোন বাঁধ মানবে?
এই আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে ইতিহাস গড়ল যে দলটি, তার নাম সাস্ট আত্মপ্রত্যয়ী। র্যাংকলিস্ট ফ্রিজ হবার পর সপ্তম স্থানে পিছিয়ে পড়েও যারা হাল ছাড়েনি, কন্টেস্ট শেষ হবার মাত্র ১৪ মিনিট আগে যারা তাদের সপ্তম এবং বাকি সবার আনসলভড একটা প্রবলেমের সলুশন সাবমিট করে ঢাকা রিজিওনালের শিরোপা জয় করার মতো একটা বিশাল কান্ড ঘটাতে পারে - তাদের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত নাম আর কীইবা হতে পারে! এই অসামান্য সাফল্যের রূপকার যে তিন প্রোগ্রামার, তারা হলেন - সৈয়দ শাহরিয়ার মঞ্জুর, নাফিস আহমেদ এবং ইমতিয়াজ শাকিল সিদ্দিকী।
পুরষ্কার নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে না যেতেই তাদেরকে ঘিরে ধরে ভালবাসায় সিক্ত করলেন উপস্থিত সতীর্থ, অগ্রজ এবং অনুজেরা। অগ্রজদের অনেকেই অফিস কামাই করে এসেছিলেন, নিজেরা সাবেক কন্টেস্ট্যান্ট ছিলেন বলে কন্টেস্টের টানকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তাদের এই উপস্থিতিকে ষোলআনা সার্থক করে তোলে আত্মপ্রত্যয়ীর এই অসাধারণ বিজয়।
আত্মপ্রত্যয়ী সমাধান করে সাতটি প্রবলেম, তাও আবার ঠিক সাত সাবমিশনে! শুধু অ্যাকুরেসিই নয়, প্রবলেম B এর একমাত্র সঠিক সমাধান আসে তাদের কাছ থেকেই। এছাড়াও প্রথম দশে সাস্টের কার্পে দিয়েম ছিল ৬টি সমস্যা সমাধান করে।
সমান সাত সমস্যা সমাধান করেও বেশি পেনাল্টির কারনে চ্যাম্পিয়ন না হতে পারলেও ওয়ার্ল্ড ফাইনালসে কোয়ালিফাই করেছে বুয়েটের [MAX+7] দল। এটি বুয়েটের সপ্তদশ ওয়ার্ল্ড ফাইনালস কোয়ালিফিকেশন, যে অনন্য রেকর্ড পৃথিবীর খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছে। গতবারের দুই ওয়ার্ল্ড ফাইনালিস্ট হাফিজ উদ্দিন এবং প্রসেনজিৎ বড়ুয়ার সাথে এই দলে ছিলেন প্রত্যয় মজুমদার। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই দলটি ছিল চ্যাম্পিয়ন হবার প্রধান দাবিদার। এমন একটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় স্থান প্রাপ্তি অবশ্যই কিছুটা হতাশাজনক। তবে ওয়ার্ল্ড ফাইনালসে অসাধারণ কিছু করতে তারা যে কোন চেষ্টাই বাকি রাখবে না, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। শীর্ষ দশে বুয়েটের বাকি তিনটা দল - ডার্কহর্স হাট-টিমা-টিম-টীম, মিথ্রান্ডির এবং কে-ডায়নেস্টি ৬টি করে প্রবলেম সলভ করে।
২০১৩ এর প্রোগ্রামিং কন্টেস্টগুলোতে সবচে’ চমকপ্রদ পারফরমেন্স ছিলো যে বিশ্ববিদ্যালয়টির সেটা নিঃসন্দেহে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। BUBT ন্যাশনাল প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে জাহাঙ্গীরনগরের সেরা পজিশন ছিলো ১০ম। ঠিক তারপরের দুটো জাতীয় কন্টেস্টে জাহাঙ্গীরনগরের পারফরমেন্স ছিলো মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো। IUT ন্যাশনালে জাহাঙ্গীরনগরের প্রথম টিমের পজিশন ছিলো ২য়। তারপর ঢাকা রিজিওনালে র্যাংকলিস্ট ফ্রিজ হওয়া পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর সবচে’ কম টাইম পেনাল্টি নিয়ে ছয়টা প্রবলেম সলভ করে শীর্ষস্থানে ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কন্টেস্ট্যান্ট এবং বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড টিমের কোচ হাসনাইন হেইকেলের নির্দেশনায় আর একঝাঁক উদ্যমী প্রতিভাবান প্রোগ্রামারের ধারাবাহিক নৈপুণ্য জাহাঙ্গীরনগরকে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলাদেশের কন্টেস্ট অঙ্গনে একটি সমীহ জাগানো শক্তি হিসেবে। প্রথম চার ঘন্টায় তাদের পারফরমেন্স দেখে মনে হচ্ছিলো নাফিস সাদিক, অনিন্দ্য মজুমদার এবং সুমন ভদ্রের JU অ্যাসাসিনস (Assassins) দলটি হয়তো প্রথম বারের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ওয়ার্ল্ড ফাইনালসের জন্য কোয়ালিফাই করিয়ে ইতিহাস গড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, সাস্ট এবং বুয়েটের শেষ ঘন্টার অভূতপূর্ব পারফরমেন্সের কাছে ম্লান হয়ে শেষমেশ দ্বিতীয় রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। তবে আশাবাদী হবার ব্যাপার হচ্ছে এই দলটি খুবই তরুণ এবং তারা অবশ্যই পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে।
IUT কন্টেস্টের দারুণ পারফরমেন্স যে কোন কাকতালীয় ঘটনা ছিল না, এই কন্টেস্টে বাঘা বাঘা দলকে পেছনে ফেলে তারই প্রমাণ দিয়েছে ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এর শরিফ আহমেদ, শুভ কর্মকার এবং মোহাম্মদ সামিউল ইসলামের দল DIU প্রিমিটিভ (Primitive)। ছয়টি সমস্যার সমাধান করে অষ্টম স্থান অর্জন করে তারা। মাত্র নয় মিনিটের মাথায় কন্টেস্টের প্রথম সঠিক সাবমিশনটি আসে তাদের কাছ থেকে। শেষ কিছু কন্টেস্টে তাদের পারফর্মেন্স দেখে মনে হচ্ছে শীর্ষ দলগুলোর মধ্যে জায়গা করে নেয়া হয়তো DIU প্রিমিটিভ এর জন্য এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
২০০৯ এ DU Dark Knights এর পরে প্রতি বছর ভীষণ শক্তিশালী দল গড়েও প্রতি বারেই রিজিওনালে তাদের সামর্থ্যের স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রিজিওনালের ঠিক আগের ন্যাশনাল কন্টেস্টটায় চ্যাম্পিয়ন হয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবারও সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা হয়নি তাদের। ১৭৬ মিনিটে প্রবলেম I সমাধান করে ৬টি সমস্যা নিয়ে প্রথম স্থানে থাকার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেবুর শরবত দলটি পিছিয়ে পড়ে বাকি ১২৪ মিনিটে কোন প্রবলেম সলভ না করে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম স্থান পায় তারা। এবারের রিজিওনালের অন্যতম ফেভারিট IUT ন্যাশনাল কন্টেস্টের চ্যাম্পিয়ন দল - মুহাম্মদ রিদোয়ান, যোবায়ের হাসান এবং মমন্থ মাসহাক মন্ময়ের DU ফ্রুট নিনজা (Fruit Ninja) ৬টি সমস্যার সমাধান করে পায় ষষ্ঠ স্থান।
প্রতিযোগিতায় দল ছিল ১১০ টি। প্রথম দশটি দল ছিল এরকম -
২. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় - BUET [MAX+7] (হাফিজ, লিংকিন, প্রত্যয়)
৩. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় - JU_Assassins (নাফিস, অনিন্দ্য, সুমন)
৪. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় - BUET Hat-tima-tim-team (আশিকুল, মুন্তাকিম, মুমিত)
৫. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় - BUET MITHRANDIR (ফরসাদ, সাদিয়া, অভিজিৎ)
৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - DU Fruit Ninjas (রিদোয়ান, যোবায়ের, মন্ময়)
৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - DU Lebur Shorbot (শাফায়েত, বিধান, রিজুল)
৮. ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় - DIU Primitive (সামিউল, শরিফ, শুভ)
৯. শাহজালাল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় - SUST_CARPE_DIEM (ধনঞ্জয়, মারুফ, আরিফুল)
১০. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় - BUET Kay Dynasty (সাকিব, রাদি, কায়সার)
পূর্নাঙ্গ র্যাংকলিস্ট মিলবে এইখানে। পুরো কন্টেস্ট লাইভ ব্লগিং করেছেন তারিফ এজাজ। তার ট্রান্সক্রিপ্ট পাওয়া যাবে এখানে। মো: মাহবুবুল হাসান ঢাকা রিজিওনালের প্রবলেমসেটের অ্যানালাইসিস আলোচনা করেছেন এই ভিডিওতে।